কবি মতিউর রহমান মল্লিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক মহানায়কঃ
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি, গীতিকার এবং ইসলামী সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের
প্রাণপুরুষ কবি মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৫০ সালের ১ মার্চ বাগেরহাট জেলার রায়পাড়া উপজেলার বড়ইগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সী কায়েম উদ্দিন মল্লিক, মাতা আছিয়া খাতুন। তিনি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর মল্লিক দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব যিনি ইসলামী ধারায় অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেছেন। তাকে অনেকেই সবুজ জমিনের কবি ও মানবতার কবি বলে থাকেন। ইসলামী সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী কবি মতিউর রহমান মল্লিকের হাত ধরেই সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠির যাত্রা শুরু।
‘সাহসের সাথে কিছু স্বপ্নজড়াও
তারপরে পথ চলে নির্ভয়
আঁধারের ভাঁজ কেটে আসবে বিজয়
সূর্যের লগ্ন সে নিশ্চয়।’
এমন সাহসী উচ্চারণে যিনি সত্যের পথে দৃঢ়ভাবে চলতে প্রেরণা জোগান এবং সাথীদের হাত ধরে সামনে যেতে শেখান তিনিই কবি মতিউর রহমান মল্লিক। বিশ্বাসী সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে দেশে-বিদেশে এক নামেই পরিচিত তিনি। কবি হিসেবে যেমন তাঁর প্রতিষ্ঠা ও সুখ্যাতি তেমনি সফল গীতিকার, সুরকার, শিল্পী হিসেবেও তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষনীয়। তবে বিশ্বাসী জনসাগরে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক মহানায়ক হিসেবেই বেশি সমাদৃত
কবি মল্লিকের বড় ভাই আহমেদ আলী মল্লিকও একজন বড় কবি। সবুজে ঢাকা মায়াময় পরিবেশে বেড়ে ওঠা মল্লিক নিজেকেও সবুজের সাথে মানানসই করেই গড়ে তুলেছিলেন। সাহাবী-কবি আবদুল্লাহ বিন রাওহা রা. এবং সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠকবি আল্লামা ইকবালের কাব্যদর্শনকে বুকে ধারণ করেই বেড়ে ওঠেন তিনি। মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাজীবন। মুহাক্কিক আলিমগণও যেমন তার উস্তাদ তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো সব্যসাচী সাহিত্য ব্যক্তিত্বেরও প্রিয়ছাত্র হতে পেরেছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও সে প্রভাব পুরোপুরি চোখে পড়েছে।
কর্মজীবন:
কর্মজীবনে কবি মতিউর রহমান মল্লিক সপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, ‘বিপরীত উচ্চারণ’ সাহিত্য সংকলনও সম্পাদনা করেছেন, মাসিক কলম পত্রিকার সম্পাদক এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের সদস্য সচিব ছিলেন।
মতিউর রহমান মল্লিক শৈশব থেকেই বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। তারপর একে একে তার অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়ল ও মাদরাসায় গড়ে ওঠে একই ধারার অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ বিশ্বের যেখানেই বাংলাভাষাভাষী মুসলমান রয়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে একই ধারার বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও অন্যান্যঃ
প্রচার বিমুখ এ ব্যক্তিটি কাজ করেছেন মানুষের জন্য,মানবতার জন্য, বিশ্বাসের জন্য। ছোট বড় সবার জন্য লিখেছেন তিনি। তার লেখা অনেক কিন্তু কমই প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত সফলতার চেয়ে আদর্শিক সফলতার কথাই বেশি ভেবেছেন। তার ভক্ত শুভাকাঙ্খীদের আকুল আকতিতে কথা ও সুর নিয়ে সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে উৎসাহের কারণে কিছু কাজকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন।- ১. নীষন্ন পাখির নীড়ে (কাব্যগ্রন্থ):আত্ম প্রকাশন, ২. সুর-শিহরণ (ইসলামি গানের বই), ৩. যত গান গেয়েছি (ইসলামি গানের সঙ্কলন), ৪. ঝংকার (গানের বই) ৫. আবর্তিত তৃণলতা (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন, ৬. তোমার ভাষার তীক্ষ্ন ছোরা (কাব্যগ্রন্থ) বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ৭. অনবরত বৃক্ষের গান (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন, ৮. চিত্রল প্রজাপতি (কাব্যগ্রন্থ) প্রফেসর’স পাবলিকেশন্স, ৯. নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রবন্ধের বই), ১০. রঙিন মেঘের পালকি (ছোটদের ছড়ার বই) জ্ঞান বিতরণী, ১১. প্রতীতি এক (ইসলামি গানের ক্যাসেট), ১২. প্রতীতি দুই (ইসলামি গানের ক্যাসেট), ১৩. প্রাণের ভিতরে প্রাণ (গীতিকাব্য) উল্লেখযোগ্য।
অনুবাদক হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পাহাড়ি এক লড়াকু নামে আফগান মুজাহিদদের অমর কীর্তিকলাপ তার বিখ্যাত অনুবাদ উপন্যাস যা কিশোকণ্ঠের পাঠকরা মন উজার করে পড়তেন নিয়মিত। মহানায়ক (উপন্যাস) ছাড়াও হযরত আলী (রা.) ও আল্লামা ইকবালের মতো বিশ্বখ্যাত মুসলিম কবিদের কবিতাও অনুবাদ করেছেন তিনি।
সেরা গান:
তার রচিত কিছু অসাধারণ গান যা জনপ্রিয়তার শীর্ষে–
১.আমার গানের ভাষা/জীবনের সাথে যেন/মিলেমিশে হয় একাকার;
২.এখনো মানুষ মরে পথের পরে/এখনো আসেনি সুখ ঘরে ঘরে/কি করে তাহলে তুমি নেবে বিশ্রাম/কি করে তাহলে ছেড়ে দেবে সংগ্রাম;
৩.টিক টিক টিক টিক যে ঘড়িটা/বাজে ঠিক ঠিক বাজে/কেউ কি জানে সেই ঘড়িটা/লাগবে কয়দিন কাজে;
৪.দাও খোদা দাও হেথায় পূর্ণ ইসলামী সমাজ/রাশেদার যুগ দাও ফিরিয়ে দাও কুরআনের রাজ;
৫.হাত পেতেছে এই গোনাহগার/ তোমারি দরগায় খোদা তোমারি দরগায়/শূন্য হাতে ওগো তুমি, ফিরাইও না হায়/ মোরে ফিরাওনা হায়;
৬.ফুলের ঘ্রাণে অলীর গুঞ্জরণে/ঐ নামেরই গান শুনে মন দেয় যে নীরব সাঁড়া/নদীর কলকলে, ঢেউয়ের ছলছলে/ঐ নামেরই সুর শোনা যায় হলে আপন হারা;
৭.ঈমানের দাবি যদি কুরবানী হয়/সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন/ ওগো দয়াময় আমার প্রভু দয়াময়;
৮.তোমার সৃষ্টি যদি হয় এতো সুন্দর/ না জানি তাহলে তুমি কতো সুন্দর
৯.ভেঙে যায় সবকিছু ভাঙে না তো মুমিনের মন/দীন কায়েমের কাজে কাটে তার সকল সময়/কাটে তার প্রতিটি ক্ষণ;
১০.চলো চলো চলো মুজাহিদ পথ যে এখনো বাকি/ভোল ভোল ব্যথা ভোল মুছে ফেলো ঐ আঁখি;
১১.পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়/ মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙিন পরিচয়;
১২.একজন মুজাহিদ কখনো বসে থাকে না/যতই আসুক বাধা যতই আসুক বিপদ/ভেঙে পড়ে না;
১৩.মাফ করে দাও এই পাপীরে/হে দয়াময় মেহেরবান, অনুতাপের অশ্রু আমার কবুল কর মহিয়ান;
১৪.আমাকে দাও সে ঈমান আল্লাহ মেহেরবান/যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে অসঙ্কোচেগায় জীবনের গান;
১৫.এই দুর্যোগে, এই দূর্ভোগে আজ/জাগতেই হবে, জাগতেই হবে তোমাকে;
১৬.সংগঠনকে ভালবাসি আমি, সংগঠনকে ভালবাসি/এ জীবনকে গড়বো বলে বারে বারে তার কাছে আসি;
১৭.আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর/আমি বলি খোদার পথেই হোক জীবন পার ;
১৮.যা কিছু করতে চাও করতে পারো/অনুরোধ শুধু ওগো পর হয়ো না/এ বুক ভাঙ্গতে চাও, ভাঙতে পারো/অনুরোধ শুধু এ ঘর ভেঙ্গো না;
১৯.কোন সাহসে চাও নেভাতে অগ্নিগীরি বলো?/চোখ রাঙ্গিয়ে যায় কি রোখা জোয়ার টল মল?/বৈশাখী ঝড় পাগলপারা, বাধন হারা/ভ্রুক্ষেপহীন আগলভাঙ্গা রুদ্র রাঙ্গা;
এরকম আরও অসংখ্য গান তাঁকে দান করেছে অমর মর্যাদা।
সেরা কিছু গান ডাউনলোড করুন লিঙ্কে ক্লিক করে
স্বীকৃতিঃ
সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কবি মতিউর রহমানের প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননাঃ
১.সাহিত্য পুরস্কার : সবুজ-মিতলী সংঘ, বারুইপাড়া, বাগেরহাট
২.স্বর্ণপদক : জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা
৩.সাহিত্য পদক : কলমসেনা সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা
৪.সাহিত্য পদক : লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ
৫.সাহিত্য পদক : রাঙামাটি সাহিত্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম
৬.সাহিত্য পদক : খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠী, বাগেরহাট
৭.সাহিত্য পদক : সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ
৮.সাহিত্য পুরস্কার : সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ, বাগেরহাট
৯.প্যারিস সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, ফ্রান্স
১০.বায়তুশ শরফ সাহিত্য পুরস্কার : বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম
১১.ইসলামী সংস্কৃতি পুরস্কার : ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম
১২.সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ফ্রান্স।
১৩.কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার।
মৃত্যুঃ
ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক মারাত্মক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে সিসিইউতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন দীর্ঘদিন।২০১০ইং সনের ১১ জুলাই ডায়ালাইসিস শেষে বাসায় ফেরার পরপরই তার কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়। প্রায় ২৫ মিনিট শ্বাস বন্ধ-মৃত প্রায় অবস্থায় হলে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে কয়েক ঘণ্টা তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে রাখা হয়। পরে নেয়া হয় স্কয়ার হাসপাতালে। তারপর ২১ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের জন্য ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
উল্লেখ্য, কবি মতিউর রহমান মল্লিককে ব্যাংকক থেকে হার্টে ৫টি রিং সংযোজন করে দেশে নিয়ে আসার পর বাসায় রেখে সপ্তাহে ৩দিন তাকে ইবনে সিনায় রেখে ডায়ালাইসিস করানো হতো। এভাবে ১ বছর পর পুনরায় ব্যাংককে নিয়ে কিডনী সংযোজনের কথা ছিল। হঠাৎ করেই কাডির্য়াক এ্যারেস্টের ঘটনা ঘটনায় কবি মল্লিক ডীপ কোমায় চলে যান। অবশেষে ১১ আগস্ট ২০১০ দিবাগত রাত ১২:৩০টায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন।
মহান আল্লাহর কাছে এই মহান মানুষের আত্মার মাগফিরাত এবং তার কর্মের উত্তম প্রতিদান কামনা করছি।
তুমি চলে গেছ বলে মন আকাশে
মেঘের ঘনঘটা আজ…
শত বিরহ মাঝে শপথ নিয়েছি নতুন
এগিয়ে নেব তোমার রেখে যাওয়া কাজ….